শুক্রবার, ২৬ আগস্ট, ২০১৬

কবি আসাদ বিন হাফিজের নির্বাচিত কবিতা

অনিবার্য বিপ্লবের ইশতেহার

আমি আমার জনগণকে আরেকটি অনিবার্য বিপ্লবের জন্য
প্রস্তুতি নেয়ার কথা বলছি
দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যেভাবে রুখে দাঁড়ায় আক্রান্ত দুর্বল
বিধ্বস্ত জাহাজ যাত্রীরা আঁকড়ে ধরে ভাসমান পাটাতন
তেমনি একাগ্রতা নিয়ে
আমি আপনাদের আসন্ন বিপ্লবের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার কথা বলছি।

বিপ্লব মানেই যুদ্ধ
বিপ্লব মানে তিল তিল বাঁচতে শেখা
বিপ্লব মানে ভাসমান রক্তপদ্ম, প্রস্ফুটিত কৃষ্ণচূড়া
বিপ্লব মানে জীবন
বিপ্লব মানে জীবনের জন্য আমরণ লড়াই।

আমি আপনাদেরকে আরেকটি অনিবার্য বিপ্লবের জন্য
প্রস্তুতি নেয়ার কথা বলছি
যে বিপ্লবে প্রতিটি নাগরিকের জীবন হয়
একেকজন যোদ্ধার জীবন
প্রাপ্তবয়স্ক প্রতিটি মানুষ হয়
একেকজন আমূল বিপ্লবী
প্রতিটি যুবক
নারীর বাহুর পরিবর্তে স্বপ্ন দেখে উত্তপ্ত মেশিনগানের
আর রমনীরা
সুগন্ধি রুমালের পরিবর্তে পুরুষের হাতে তুলে দেয়
বুলেট, গ্রেনেড।

আমি আমার জনগণকে
অনিবার্য সেই বিপ্লবের জন্য
প্রস্তুতি নেয়ার কথা বলছি।

বিপ্লব মানেই যুদ্ধ
বিপ্লব মানেই সংগ্রাম, সংঘাত
বিপ্লব মানে শিরায় শিরায় উদ্দাম ঝড়
ঝড়ো হাওয়া, টর্নেডো, সাইক্লোন
বিপ্লব মানে কল্লোলিত সমুদ্রের শোঁ শোঁ অশান্ত গর্জন
বিপ্লব মানে আশা, সফলতা ও বিজয়ের অমোঘ পুষ্পমাল্য।

আমি আমার জনগণকে আরেকটি অনিবার্য বিপ্লবের জন্য
প্রস্তুতি নেয়ার কথা বলছি
যে বিপ্লব সাধিত হলে মানুষের শরীর থেকে
খসে পড়ে শয়তানের লেবাস
জল্লাদের অশান্ত চিত্তে জন্ম নেয় বসরাই গোলাপ
অর্ধ পৃথিবীর দুর্দান্ত শাসক
কেঁপে উঠে ফোরাত কূলের কোন
অনাহারী কুকুরের আহার্য চিন্তায়।

যে বিপ্লব সাধিত হলে
কন্যা হন্তারক অভাবী পিতাদের জন্য পরওয়ারদিগার
খুলে দেন রহমতের সব ক'টি বদ্ধ দুয়ার।
তখন কোন অভাব আর অভাব থাকে না
উদ্বৃত্ত সম্পদ প্রদানের জন্য
পাওয়া যায় না কোন ক্ষুধাতুর বনি আদম।

অন্ধকার যত ঘনীভূত হয় ততই উজ্জ্বল হয় বিপ্লবের সম্ভাবনা
একটি কৃষ্ণ অন্ধকার মানেই
সামনে অপেক্ষমান একটি প্রস্ফুটিত সূর্যোদয়
একটি আরক্ত সন্ধ্যা মানেই
বেগবান বোররাক চেপে ধেয়ে আসছে কোন কুসুম সকাল
একটি কৃষ্ণ মধ্যরাত মানেই
তার উল্টো পিঠে বসে আছে কোন মৌমাছি দুপুর
একটি মিথ্যা মানেই
তাকে ধাওয়া করছে কোন দ্রুতগামী সত্যাস্ত্র
একটি অবাধ্য সমাজ মানেই
সামনে নূহের প্লাবন, অনাগত ধ্বংস
আরেকটি নতুন সভ্যতার আমূল উদ্বোধন।

আমি আপনাদেরকে সেই
অনিবার্য বিপ্লবের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার কথা বলছি
দিন ও রাত্রির প্রতিটি আবর্তনে
শোনা যায় যে বিপ্লবের অশ্বখুরধ্বনি
ঋতুচক্রের প্রতিটি আবর্তনে
শোনা যায় যে বিপ্লবের অশ্বখুরধ্বনি
মাস ও বৎসরের প্রতিটি ঘূর্ণিপাকে
শোনা যায় যে বিপ্লবের অশ্বখুরধ্বনি
যুগ ও কালের প্রতিটি ঘূর্ণিপাকে
শোনা যায় যে বিপ্লবের অশ্বখুরধ্বনি
শতাব্দীর প্রতিটি পরতে পরতে যে বিপ্লবের পলিময় মৃত্তিকা।

আমি আমার জনগণকে সারাক্ষণ বুকের মধ্যে
বিপ্লবের চাষ করতে বলছি
যে বিপ্লবের চাষ করলে
প্রজ্জ্বলিত অগ্নি হয় জাফরান বীথি
যে বিপ্লবের চাষ করলে
নীলনদের আহার্য হয় অবাধ্য ফারাও
আবরাহার হাতি হয় পাখির খোরাক
চুরমার হয়ে যায় রোম ও পারস্যের বিশাল সালতানাতের দাম্ভিক চূড়া।
ব্যর্থ হয়ে যায় কারুণের ধন
কল্পিত স্বর্গদ্বারে হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকে
অবাধ্য সাদ্দাতের দশটি আঙ্গুল।
আর কারাগারের কয়েদী বন্দী ইউসুফ
কুদরতের ইশারায় রাজ মুকুট পরে হয়ে যান বাদশা কেনান।

আমি আমার জনগণকে
আসন্ন সেই বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি।

যেখানে অন্ধকার সেখানেই বিপ্লব
যেখানে ক্লেদাক্ত পাপ ও পঙ্কিলতার সয়লাব
সেখানেই বিপ্লব
যেখানে নগ্নতা ও বেহায়াপনার যুগল উল্লাস
সেখানেই বিপ্লব
যেখানে মিথ্যার ফানুস
সেখানেই বিপ্লব
যেখানে শোষণ ও সূদের অক্টোপাশ ক্যান্সার
সেখানেই বিপ্লব
বিপ্লব সকল জুলুম, অত্যাচার আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে
বিপ্লব অন্তরের প্রতিটি কুচিন্তা আর কুকর্মের বিরুদ্ধে।

আমি আপনাদের সকলকে
বিপ্লবের মৌসুমের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।

মৌসুম ছাড়া কোন বসন্ত আসে না, বর্ষা আসে না
মৌসুম ছাড়া ফোটে না কৃষ্ণচূড়া, পলাশ, শিমুল
সময়কে ধারণ করতে না পারলে গর্ভবতী হয় না কোন রমনী
ফলবতী হয় না সবুজ ধানের শীষ
সীম আর মটরদানা
সময়কে ধারণ করতে না পারলে সফল হয় না বিপ্লবের আরাধ্য কাজ।

কৃষ্ণ মধ্যরাত পেরিয়ে আজ বিংশ শতাব্দী ছুটছে প্রত্যুষের দিকে
সাইবেরিয়ার বরফ খন্ডে মুখ লুকোচ্ছে পাশবতন্ত্র
আ'দ ও সামুদ জাতির মত টেক্সাসের ঘোড়াগুলোকে
ঘিরে ফেলেছে আল্লাহর গজব।
ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, বসনিয়া, কাশ্মীর, পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তরে
লাউডস্পীকারের সামনে দাঁড়িয়ে গেছে যুগের মুয়াজ্জিন
আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে এখনি আজান হবে
সে আওয়াজের নিচে হারিয়ে যাবে
এটম ও কামানের ধ্বনি
গড়িয়ে যাওয়া অজুর পানিতে ভিজে অকেজো হয়ে পড়বে
সব ক'টি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র।
আবাবিল পাখির ঝাঁক গিলে খাবে আকাশ ফড়িং
রাজহাঁসগুলো শামুকের পরিবর্তে গিলে খাবে জীবন্ত টর্পেডো
সাদা কবুতরের পাখনায় আটকা পড়ে
থেমে যাবে আনবিক ঝড়
আর বেহেশ্ত্ থেকে শহীদেরা
আপনাদের বিজয় অভিনন্দন জানানোর জন্য
মার্চপাস্ট করতে করতে এসে দাঁড়িয়ে যাবে রাস্তার দু'পাশে।

তাদের প্রত্যেকের হাতে থাকবে একটি করে রক্ত গোলাপ
সজীব ও তরতাজা
চিত্তহারী ঘ্রাণময়
আমি আপনাদের সেই আনন্দিত
অনিবার্য বিপ্লবের পতাকা উত্তোলনের জন্য উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি।














অবশেষে দেশপ্রেমিকরাই জয়ী হয়

ইতিহাস পড়ে পড়ে জেনেছি চিরকাল
অবশেষে দেশপ্রেমিকরাই জয়ী হয়।
বুলেট, বেয়নেট, গুম, খুন, হত্যা, সন্ত্রাস,
কারাগার, নির্যাতনÑ
সেই বিজয়-পথের একেকটি ফলকমাত্র।

কারাগার মানে বিপ্ল¬বের সুতিকাগার।
আসন্ন সংগ্রামের পরিকল্পনা প্রণয়নের
    নিরাপদ আবাসস্থল।
জনতার কোলাহল মুক্ত নিরিবিলি পরিবেশ।

একজন জাতীয় নেতাকে কারাগারে দেয়া মানেÑ
মুক্তিকামী মানুষের স্বপ্ন পূরণের জন্য
সেই পরিকল্পনা প্রণয়নের একটু সুযোগ করে দেয়া।
একজন জাতীয় নেতাকে কারাগারে দেয়া মানেÑ
অব্যর্থ আঘাত হানার জন্য একজন বিপ্ল¬বীকে
প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়ার সামান্য অবকাশ দেয়া।
একজন জাতীয় নেতাকে কারাগারে দেয়া মানেÑ
গণবিরোধী সরকারের জন্য
আধুনিক সমরাস্ত্রের চেয়েও তিনি যে ভয়ংকর
এ কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করা।
আর
একজন দেশপ্রেমিক নেতার ফাঁসির আদেশ দেয়া মানেÑ
তাঁর বীরত্ব ও সাহসের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য
            রাজ্য জুড়ে
মুক্তিপাগল মানুষের কাছে ঢেড়া পিটিয়ে দেয়া।



আর বুলেট বেয়নেটের প্রশ্ন?
একটি বুলেট বড়জোর একটি বুকই
এফোঁড় ওফোঁড় করতে পারে।
কিন্তু একজন শহীদের একফোঁটা রক্ত
নিমিষে লক্ষ কোটি জনতার মনে
জ্বেলে দিতে পারে বিপ্ল¬বের দাউদাউ আগুন।
সে আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যেতে পারে
    কুচক্রীর নরম ফোমের গদী।
চৈত্রের উত্তপ্ত অরণ্যে দেয়াশলাইয়ের
    সামান্য এক শালাকা
যেমন মুহূর্তে সৃষ্টি করতে পারে
    লেলিহান দাবানল
তেমনি মাত্র একজন শহীদের রক্ত
বিক্ষুব্ধ জনতার উত্তোলিত হাতগুলোকে
অবলীলায় বানিয়ে দিতে পারে টান টান মিসাইল।




















মূলধারা

রাতের আঁধারে চুপচাপ পড়ে আছে
        বিবর্ণ পান্ডুর চাঁদ
চাঁদ নয়, যেন কোন মরা রূপচাঁদা
আধেক খেয়েছে যার কালো কোন কীট,
        পড়ে আছে আঁধ
    যেন সব মৃত বস্্নিয়া
লাশের শরীরে উড়াউড়ি করে
        পুঁজখেকো মাছি
মনে হয়, সুনসান ভয়ার্ত রাতে
আজদাহা ভয়াল দ্বীপে মৃতবৎ একাÑ
        শুধু একা পড়ে আছি।

মেঘরঙ বিষণœ সময়ের পেটে
পড়ে আছে আমাদের ধূসর জীবন
মাঝরাতে একা এক উদাসী বাউল
পাড়ি দিতে গিয়ে কোন গোবী মরুভূমি
ফেঁসে গেছে সময়ের ফাঁদে।
বিশ্বাসের ধ্রুবতারা
কুয়াশার ধূসর জালে হয়েছে আটক।
চেতনার মিহিস্বরে বেদনার বিরহ বিলাপ।

গান নয়, সুর নয়, একতারা মনÑ
নির্মম কালের স্রোতে হু হু করে কাঁদে,
            শুধু কাঁদে।
ফ্যাকাশে ঘোলাটে চোখে চেয়ে থাকে
                আদম সুরাত
কারা যেন তুলে দেয় চেতনার সোনারোদে
                অদৃশ্য গরাদ
রাত গিয়ে রাত আসে, আসে না প্রভাত।
তস্কর হানা দেয় লোকালয় জুড়ে
লালা ঠোঁটে লোভী যত বাদুড়েরা ওড়ে
মানুষ ঘুমের ঘোরে স্বপ্নহীন কাটায় প্রহর।
চেতনার কড়িকাঠে বেঁধেছে কি বাসা কোন ঘুণ?
রূপসীর কালো চুলে অসহ্য উকুন?
কার অপরাধে, নিস্তেজ হয়ে আসে ঈমানী আগুন?
কার পাপে ব্যর্থ হয় শহীদের খুন?
কালের দেয়ালে দেখি সেই কথা লেখা হয়ে আছে
দীঘল দীর্ঘশ্বাসে সেই কথা অনর্গল
        ভাসে শুধু ভাসে।
ক্ষয়রোগে সবকিছু ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়
বিবর্ণ বুকের হাড়ে স্মৃতি রয়ে যায়।
নি:শ্বাসে নি:শ্বাসে তবু আমি কবি
বুনে যাই উম উম আদুরে চাদর
        বিশ্বাসের ঘর।
নিরবধি বারোমাসÑ
চেতনার মিহিদানা করে যাই চাষ।
মাঝরাতে বাউলের কাঁেদ একতারাÑ
মরে নাই...মরে নাই ..দেখো ওই নীলিমায়
জাগে ধ্রুবতারা। ম্রিয়মান তবুয়ো আজন্ম অনড়
শীলাদৃঢ় বিশ্বাসে অটল পাথর
সারারাত ডেকে ডেকে বলে বলে যায়Ñ
সকলি বিনাশ হয়
একা শুধু বেঁচে থাকে তবু মূলধারা।

শতাব্দী প্রভাতে তাই মানুষের পাড়া
জেগে ওঠে, হেসে ওঠে বিশ্বাসের আলো
দূর হয় মরা ঘুম, রাতের কালো
বেজে উঠে দেশে দেশে ভোরের আজান
জনপদে জাগে দেখো পুষ্পের ঘ্রাণ
আড়মোড়া ভেঙে জাগে শত জনপদ।
সকালের মিঠে রোদে পড়ে যায় সাড়া
মরে নাই ... মরে নাই ... দেখো মূলধারা।












বিজয়ের চুমু

যে রমনী দশ মাস দশদিন গর্ভধারণ করতে রাজি নয়
রাজি নয় প্রসবকালীন অসহ্য কষ্ট ও যন্ত্রণা ভোগ করতে
পৃথিবীতে সে কোনদিন মা হওয়ার
গৌরব অর্জন করতে পারে না।

যে মৃত্তিকা লাঙলের ফলার আঁচড় খেতে রাজি নয়
রাজি নয় বৃষ্টির জলে ¯œান করতে,
পৃথিবীতে সে কোনদিন সবুজ উদ্যান রচনার
গৌরব অর্জন করতে পারে না।

যে বিপ্লবী জেল, জুলুম, টিয়ারগ্যাস ও গুলি খেতে রাজি নয়
রাজি নয় ফাঁসির মঞ্চে সাহসের দুন্দুভি বাজাতে
পৃথিবীতে সে কোনদিন সাফল্যের
গৌরব অর্জন করতে পারে না।

বাঁচতে হলে মরতে শেখো, জীবন তোমার পায়ে চুমু খাবে।

মালিবাগ চৌধুরী পাড়া, ২৭ জুলাই, ২০১৩, রাত ২টা।



আজ আর কোন কবিতা নয়

আপনারা মাফ করবেন আমাকে।
আসলেই কবিতা শোনাবার মত কোন অবস্থা নেই আমার।
আমি একেবারেই বিপর্যস্ত ও বিধ্বস্ত। ড্রাকুলা সময় আমাকে
নিঃস্ব ও ফকির করে পথে বসিয়ে দিয়েছে। কিছু বুঝে ওঠার
আগেই আমি বন্দী হয়ে গেছি হন্তারক সময়ের হাতে।

বিশ্বাস করুন, আমার অবস্থা এতটা খারাপ ছিল না।
আমার একটা অতীত ছিল। সম্ভ্রান্ত আর মানবিক অতীত।
অভাবের সাথে ঘরগেরস্থালি করতে হয়নি আমাদের।
সংসারের কাজ সেরে বিকালে ফুটবল খেলা আর রাতে
গাজী কালু চম্পাবতীর পুঁথি বা কবির লড়াই শোনার মত
অঢেল সময় ছিল আমাদের পূর্বপুরুষের হাতে।
হন্তারক সময় ভুলিয়ে ভালিয়ে সেই আসর থেকে আমাদের
তুলে এনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে বাঘবন্দী সময়ের খাঁচায়।

এখন যেদিকে তাকাই চাপ চাপ অন্ধকার আর প্রতারণা।
প্রতারণা আমাদের মেধা ও মননে, আমাদের শিরায় শিরায়।
পথে পথে গলাগলি করে হেঁটে বেড়ায় অন্ধকার ও প্রতারণা।
তারা ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকে শিতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে কক্ষে।
অফিসে, আদালতে, হাটে-মাঠে সর্বত্র অন্ধকার ও প্রতারণা।
শীতের হিমেল হাওয়ার মত তারা শহর, নগর, বন্দর সব
ঘিরে ফেলেছে। অনায়াসে ঢুকে গেছে গণভবন ও বঙ্গভবনে।

বিচারকের এজলাসে এজলাসে অন্ধকার ও প্রতারণা।
শহুরে বাবুদের কোটের পকেটে অন্ধকার ও প্রতারণা।
সচিব ও আমলাদের টেবিলের ড্রয়ার আর টাইয়ের নিচে
চাপ চাপ অন্ধকার ও প্রতারণা ঘাপটি মেরে ওঁৎ পেতে আছে।
আর আমাদের সবচে কাছের ও দূরের মানুষ,
জনগণনন্দিত নেতাদের ধোপদুরস্ত আদ্দি পাঞ্জাবীর পকেটের
থোক থোক অন্ধকার ও প্রতারণা আমাদের অন্ধ করে দিয়ে
কী চমৎকার ডুগডুগি বাজাচ্ছে। তাদের ঠোঁটের ভেতর,
জিহবার নিচে, চুলের ডগায়, প্রতিটি লোমকুপে
গুদামজাত হয়ে আছে ভয়ংকর অন্ধকার ও কুৎসিত প্রতারণা।
যেদিকে তাকাই সর্বত্রই অন্ধকার ও প্রতারণা কিলবিল করছে।
এ অবস্থায় কেমন করে আপনাদের কবিতা শোনাবো বলুন?

বিশ্বাস করুন, পথে পথে ওঁৎ পেতে থাকা ভয়ঙ্কর মৃত্যু-আতঙ্ক আর
বেডরুমে হানা দেয়া গোপন আততায়ীর ভয়ে আমি দিশেহারা।
যে দেশে রাজপথে নিত্যদিন খুনের মহড়া চলে
যে দেশে সত্য কথা বললে যেতে হয় জেলে
সে দেশে আপনারা কেউ আমাকে কবিতা পড়তে বলবেন না।
আপনারা কেন বুঝেন না, কবি হওয়ার পরও আমি একজন মানুষ,
আমারও বাঁচতে ইচ্ছে করে। তাই আমি
আপনাদের সকলের কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাচ্ছি,
আজ আর কোন
কবিতা নয়।
আমাকে বাঁচতে দিন।




সমঅধিকারের জন্য


সমঅধিকারের জন্য যারা কাঁদে
তারা কাবায় আসে না কেন?
কি নেই এখানে?
পৃথিবীর তাবৎ সৌন্দর্য যাদুর মত যখন
আছড়ে পড়ে চোখের কার্ণিশ আর হৃদয়ের বারান্দায়,
তখন বিভেদের সব দেয়াল ভোজবাজির মতই কি
মিলিয়ে যায় না মহামিলনের মহানীলিমায়?

কাবার দেয়ালের মত চকচকে নাইজেরিয়ান রমনী,
ইরানের লাল টকটকে গোলাপগুচ্ছ,
আরবী তাজি ঘোড়ি, রাশিয়ার পেজাতুলোর মত
বরফকুচি, সুদানী বাদামী চামড়া,
থাইল্যান্ডের কারুকার্যখচিত অমূল্য তৈজষপত্র,
প্রাণবন্ত জাপানী রোবট, চাইনিজের চারুময়
চীনামাটির তশতরীসদৃশ চেহারায়
লেপ্টে থাকা নয়ন যুগল,
সোমালিয়ান স্ট্যাচুতে লাগানো জোড়া মার্বেল,
ইথিউপিয়ার কালো গ্রানাইট পাথর,
রাজহংসী আমেরিকাÑ কি নেই এখানে?

দিন ও রাত্রির প্রতিটি প্রহর,
প্রতিটি মুহূর্ত,
প্রতিটি সেকেন্ড-ক্ষণ
কাবা প্রদক্ষিণ করছে বিচিত্রসব নারী ও নরÑ
অনবরত, বিরামহীন।
কি মধ্য দুপুর, কি মধ্যরাত, সন্ধ্যা-সকাল,
শুক্র-মঙ্গল, ভেদাভেদহীন, অভিন্ন হৃদয়।

নারী নয়, নর নয়, ইরাকী-বার্মিজ নয়,
বাঙালি-পাকিস্তানি নয়, শুধুই মানুষ করে
কাবায় তাওয়াফ।
চোখের পানিতে ধুয়ে ফেলে
হিংসা ও ঘৃণার কালি
মানুষ জড়িয়ে ধরে আদমের হাত
উধাও চকচকে লোভ, স্বার্থের সংঘাত
কি নেই এখানে?

পাশ্চাত্য পুঁজিবাদের চোখে যখন সবই পণ্য,
এমনকি মানুষ এবং মানবতাও
ভেজালবিরোধী অভিযান হয় না বলেই
সভ্যতার শপিংমলে আজো তা শোভা পায়।
বস্তুত: পাশ্চাত্যের মাকাল ফলের
তিক্ত জারক খেতে খেতে মানুষ ভুলে গেছে
আঙুর ও আপেলের স্বাদ।



















নমরুদের ঘিলু

হে মাবুদ, আমরা আমাদের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছি।
আমাদের জান, মাল, সব, সব।
শুধু দ্বীনকে ভালবাসার কারণে অমানুষিক জুলুমের শিকার হয়েছি।
বেধড়ক লাঠিপেটা খেয়েছি। টিয়ারসেল খেয়েছি।
আমাদের ধরে ধরে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে।
গুম করা হচ্ছে। আমাদের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে রাজপথ।

আমাদের নেতৃবৃন্দকে মিথ্যা মামলা দিয়ে
কারাগারে প্রেরণ করা হচ্ছে।
তাদের বিচারের নামে চলছে নাটক।
 চলছে জঘন্যতম প্রহসন।

মাবুদ আমার! আমরা হাসিমুখে জেলের জুলুম সহ্য করছি।
শুধু তোমার দ্বীনের জন্য হাসিমুখে বুকে নিচ্ছি বুলেট।
পৃথিবী ক্রমেই আমাদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে আসছে মাবুদ!
রিমান্ডের নামে আমাদের ওপর যে বর্বরতা চালানো হচ্ছে,
যে পৈশাচিকতা চালানো হচ্ছে তা ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়।
মাবুদ, তোমার দ্বীনকে ভালবাসি বলে আমাদের হাতে
হাতকড়া পরানো হচ্ছে। পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরানো হচ্ছে।
তোমার হাবীবের সুন্নাত মুখে থাকায় কমবখতের দল
সেই দাড়ি ধরে টানাটানি করছে, উপহাস করছে।

তোমার দ্বীনকে ভালবাসি বলে ওরা আমাদের চোখ বেঁধে
মারতে মারতে ফেলে রাখছে শক্ত কংক্রীটের মেঝেতে।
আমাদের রক্তে সেই মেঝে লাল হচ্ছে।
তোমার দ্বীনকে ভালবাসি বলে নরাধমরা আমাদের
উলঙ্গ করে ঝুলিয়ে রাখছে কড়িকাঠের সাথে।
হাত ও পায়ের নখ উপড়ে নিচ্ছে।
ইলেক্ট্রিকের চেয়ারে বসানো হচ্ছে।

এক মামলায় খালাস পেলে
জেলগেট থেকেই ধরে নিয়ে নতুন করে মামলা দিচ্ছে।

ছেলেকে মুক্ত করতে গেলে আটক করছে বাপকে।
বাপকে দেখতে গিয়ে গ্রেফতার হচ্ছে ছেলে। আর
কোন মা ও বোন যদি এইসব নিরপরাধ ব্যক্তির
মুক্তি দাবী করে, তবে রেহাই পাচ্ছে না তারাও।

হে আমার রব, হে মাবুদ মাওলা! আমাদের
কষ্টের কথাগুলো বর্ণনা করার ভাষা আমার না থাকতে পারে,
কিন্তু তোমার তো অজানা নয় কোনকিছু।
মাওলা গো! আর তো পারি না সইতে এ অসহ জ্বালা।
‘আহাদ, আহাদ’ বলতে বলতে আমরা যদি নিঃশেষ হয়ে যাই,
তাতে তোমার কী লাভ হবে মালিক! তুমি কি পাঠাবে না
তোমার পক্ষীবাহিনী আবরাহার হস্তিকূল ধ্বংস করতে?
মাবুদ, কখন আসবে তোমার মদদ?
কখন ঝরবে তোমার রহমতের বৃষ্টি?
আর যে পারি না প্রভু।

হে আল্লাহ,
আমাদের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছি তোমার জন্য,
এবার তুমি তোমার ওয়াদা পূর্ণ করো।
গায়েবী মদদ পাঠাও।
কুদরতি সাহায্য পাঠাও।
আর আমাদের পরীক্ষা নিও না প্রভু।
আমরা যে বড় দুর্বল, বড়ই কমজোর।
মাবুদ, নমরুদের ঘিলু তছনছ করার জন্য
একটি মশাই তো যথেষ্ট।

















ঈমানের মূল্য

মাকসুদা, অন্ধকারে বাতি নিভিয়ে চুপচাপ বসে আছি বিছানায়।
ভাবছি তোমার কথা। আমার মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে, তুমি
গারদের মেঝেতে বসে কাটাচ্ছ বিনিদ্র প্রহর। কী অপরাধ তোমার?
পবিত্র রমজানে বসে বসে কোরানের আলোয় সাজাচ্ছিলে হৃদয় ভূ-ভাগ
এই কি অপরাধ? শুধু আমি কেন, তোমাকে যারা চেনে তারা সবাই জানে,
তোমার মত একজন পরোপকারী পূণ্যবান মানুষ এ সমাজে সত্যি দুর্লভ।
এই ভাল মানুষ হওয়াটাই কি অপরাধ? যৌবন ঝুলিয়ে যারা ট্রয়নগরীর
ধ্বংস ডেকে আনে তুমি সেখানে হেজাবের পবিত্রতা ছড়িয়ে দাও।
এই পবিত্রতা ছড়ানোই কি তোমার অপরাধ?

আমি ভাবতে পারছি না, আমি এখন কোন্্ অসভ্য নগরে বসবাস করছি।
নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশে রোজা রাখা অপরাধ! শরিয়ত মানা অপরাধ?
আর এই অপরাধে রোজা রাখা বয়স্ক মহিলাদের ধরে নিয়ে
হাজতে পুরতে হবে? ওরা কি জানে জীবন থেকে মৃত্যুর দূরত্ব কতো?
যখন থামবে এই দেহঘড়ি তারপর কী হবে? নধর শরীর হবে পঁচা লাশ।
দুর্গন্ধ থেকে বাঁচার জন্য সেই লাশ মাটিচাপা দেবে মানুষ। (ওরা তো আর
ফেরাউন নয় যে, ওদের দেহ মানুষ মমি করে রাখবে?)

মাকসুদা, মিন্টুরোডের যেখানটায় এখন তুমি আছো, তার পাশের
প্রাসাদগুলোতে থাকেন যে মান্যবর মন্ত্রীরা, সামান্য এই দেয়ালের
বাঁধা যদি অপসারিত হয়, যদি তুমি বনে যাও তার বাসিন্দা,
তাহলে আজ যারা তোমাকে ধরে ছুঁড়ে দিয়েছে গারদখানায়, ওরাই
তোমার পায়ের নিচে গড়াগড়ি খাবে স্যার স্যার বলে। এটাই ইতিহাস।
ক্ষমতার মসনদের দূরত্ব তো এক দেয়ালের বেশী নয়। বুঝি না,
ওরা কেন যে তোমাকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য হন্যে হয়ে গেছে!
কেন ধরে ধরে তোমাদের চেনাচ্ছে মিন্টুরোড?

মাকসুদা! দেখতে দেখতে এসে গেলো কদরের রাত, তুমি জেলখানায়।
কংক্রিটের মেঝেতে লুটিয়ে কাঁদছো তুমি, আর সে কান্নায় কেঁপে উঠছে
আল্লাহর আরশ। তোমার অশ্রুতে এসে মিশছে এক অপার্থিব সৌরভ।
জেলখানার দেয়াল টপকে সে সৌরভ এসে ঢুকছে আমার নাসিকায়।
তুমি কাঁদছো, সৌরভ ছড়িয়ে পড়ছে বাংলার মাঠে, ঘাটে।
তুমি কাঁদছো, ইথারে ভর করে সৌরভ ছড়িয়ে পড়ছে প্রতি ঘরে ঘরে।
তুমি কাঁদছো, সে সৌরভ ঢুকে যাচ্ছে মানুষের হৃদয়ের গভীরে।
মনে হয় ফেরেশতারা বেহেশতী সেন্টের কৌটা উপুড় করে দিয়েছে।

যারা বাংলার মায়েদের শান্তিতে ইফতার করতে দেয়নি, যারা রমজানের
পবিত্র দিনে আপন সন্তানকে বঞ্চিত করেছে মায়ের আদর থেকে, যারা
হেজাবের অসম্মান করেছে, কোরআনের মজলিশ থেকে মেয়েদের
ধরে নিয়ে যারা অপমান করেছে পবিত্র কোরআনের, যারা ঈদের
আনন্দকে ভরিয়ে দিয়েছে হাহাকারের রোদনে, বাংলার মুসলমানদের
কী দায় ঠেকেছে তাদের নেতা বানানোর? দুশ্চরিত্র প্রতারকদেরই
বার বার ভোট দিতে হবে, তাদের হাতেই তুলে দিতে হবে গদী, তবে
আল্লাহর গযব ফেরাবো কী দিয়ে? কী দিয়ে ফেরাবো অনাগত
ধ্বংস-প্রলয়? আমার ঈমানের কী কোন মূল্য নেই?


















অনিশেষ ত্রাণকর্তা

গুম, খুন, হত্যা, সন্ত্রাস করে
মুক্তিকামী জনতাকে দাবিয়ে রাখা যায়
এমন খবর বলো, কে শুনেছে কবে?
জেল, জুলুম, অপহরণ করে
কে কবে পেরেছে করতে বন্দী স্বাধীন হৃদয়?
মিথ্যার কোরাস দিয়ে সত্য কি ঢেকে রাখা যায়?
তবে কেন এই মিথ্যার অপলাপ, প্রহসন?
কেন সূর্যকে বন্দী করার এতো আয়োজন?

আমরা কি কিছুই দেখিনি প্রলয়ের রাতে?
কাউকে কিছু না বলে, জাতিকে অসহায় ফেলে
তোমরা তো পালিয়েছিলে নিরাপদ জোনে।
যখন চারপাশে ভয়াল মৃত্যু নাচছিল, কে ছিল সহায়?
কে ওদের বুঝিয়েছিল, এরা সব নিরীহ মানুষ।
প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে কারা বলেছিল, দয়া করে
এদের মারবেন না, এরা সব দেশপ্রেমিক?

সাড়ে ছয় কোটি মানুষের যারা ছিল পাশে পাশে
শান্তির পতাকা হাতে যারা ছিল একান্ত সহায়
যাদের কারণে নিরাপদ ছিল আমাদের জীবন
রক্ষা পেয়েছিল আমাদের ঘরবাড়ি, সহায়-সম্পদ
আমাদের পরিজন, স্ত্রী-সন্তান, সাড়ে নয় মাস
যাদের ডান্ডিকার্ড নিয়ে মুক্তিরা ছিল নিরাপদ, যারা
সাড়ে ছয় কোটি মানুষের ছিল অনিশেষ ত্রাণকর্তা,
আর্মিরা ধরে নিয়ে গেলে যারা ছাড়িয়ে আনতো
যাদের সাথে ছিল না আমাদের বিবাদ বিসম্বাদ
তাদের নামে দিচ্ছো আজকে অলীক অপবাদ!

আমরা লড়াই করেছি বাংলার কৃষক, শ্রমিক, জনতা
তোমরা ওপারে বসে খেয়েছো উদ্বাস্তু ক্যাম্পের খুদ
আমরা মরেছি, ধরেছি অস্ত্র, মেরেছি শত্রু সেনা
লড়াইয়ে তোমরা আসোনি তাই নিজেরা তো মরলে না।

্এমপি মরেনি, মরেনি দেশের কোন জাঁদরেল নেতা
তারামন বিবি ইজ্জত দিয়ে এনেছে স্বাধীনতা।
স্বাধীনতাপদক পেয়েছে সে, তোমার ভান্ডার খালি
নিজের দোষ ঢাকতে আজকে অন্যকে দাও গালি।
তোমার লুটের হয় না দোসর, ওরা যে সত্যবাদী
তাই দুর্দিনের সে ত্রাণকর্তাকে বানাও অপরাধী।

আজকে ওদের জেলে পুরছো, দিচ্ছো ওদের ফাঁসি
কে ছিল পাশে, পলাতক কে, জানে তা বঙ্গবাসী।
ওরা পাশে ছিল আমরা ছিলাম সাড়ে ছয় কোটি প্রাণ
প্রতারক চক্র আজকে তাদের দিচ্ছে বলিদান।
অনিশেষ ত্রাণকর্তা ছিল যারা সে কঠিন দুর্দিনে
আমরা আজো বাধা যে তাদের ভালবাসার ঋণে।




























ভালবাসি এই মাটি

ভালবাসি এই মাটি, মানুষের মন
ভালবাসি বাংলার প্রিয় জনগণ
ভালবাসি নদীর এই কল-কলতান
ভালবাসি পাখিদের সুমধুর গান
আমার কবিতা গান তাদের জন্য
তাদেরকে ভালবেসে আমি ধন্য।

ভালবাসি বাংলার বন-উপবন
ভালবাসি কৃষকের মধুর স্বপন
ভালবাসি তাহাদের স্বাধীন চেতন
ভালবাসি শ্রম ঘাম কঠিন জীবন
তাহাদের সকলের পণ অনন্য
তাদেরকে ভালবেসে আমি ধন্য।

ভালবাসি ফুলপাখি পাহাড় নদী
শাপলা শালুক আর ভরা জলধি
ভালবাসি নাও নদী জলভরা ঘাট
ভালবাসি প্রাণকাড়া ফসলের মাঠ
ভালবাসি উৎসব ভরা জনারণ্য
তাদেরকে ভালবেসে আমি ধন্য।
















সর্পবিষয়ক

স্বৈরাচারের ন্যায় ভীতু কোন জন্তু
পৃথিবীতে আর কোনদিন জন্মগ্রহণ করেনি।

তার চারদিকে কেবলই ভয়ের মাতম।
দরজার চৌকাঠে ভয়, জানালার গ্রীলে ভয়
মখমলের বিছানায় ভয়, বাথটাবে ভয়
ভয় কিলবিল করে নর্তকীর নাচের মুদ্রায়।

স্বৈরাচারের ন্যায় ভীতু কোন জন্তু
পৃথিবীতে আর কোনদিন জন্মগ্রহণ করেনি।
মায়ের কোলে শিশু নিশ্চিন্তে ঘুমায়
আর স্বৈরাচার আতঙ্কে তড়পায়।
সে নিজের হাতকে বিশ্বাস করে না,
চোখকে বিশ্বাস করে না,
এমনকি নিজের নি:শ্বাসকেও বিশ্বাস করে না।
ঘুমের ভেতর ভয় তাকে তাড়া করে
দুধের বাটিতে চুমুক দিতে ভয় পায় স্বৈরাচার
দুধের বাটিতে সে দেখে লাল লাল তাজা রক্ত।

স্বৈরাচারের ন্যায় ভীতু কোন জন্তু
পৃথিবীতে আর কোনদিন জন্মগ্রহণ করেনি।
সে সবচে বেশি ভয় পায় মানুষকে।
ভয় পায় গণজাগরণ ও গণজোয়ারকে।
আর তাই মানুষ দেখলেই সে তার
পোষা কুকুরগুলোকে লেলিয়ে দেয় মানুষের বিরুদ্ধে।
সাপের মত বিষাক্ত ফণা তুলে ছুটে আসে ছোবল হানতে।
আর বাঁচার জন্য মানুষ তখন বাধ্য হয়
দল বেঁধে স্বৈরাচার ও তার কুকুরদের তাড়া করতে।














কবিকে ভয় পাওয়ার কী আছে
তুমি আমাকে কারাগারে বন্দী রেখেছো। কিন্তু কেন?
তুমি কি আমাকে ভয় পাও? কবিকে ভয় পাওয়ার কী আছে?
কবির কাছে থাকে কলম। কলমের ডগায় থাকে সত্য ও সুন্দর।
তবে কি তুমি সত্য ও সুন্দরকে ভয় পাও?

কবির কাছে আর কি থাকে? আর থাকে প্রেম ও ভালবাসা।
তুমি কি ভালবাসাকে ভয় পাও? প্রেমকে ভয় পাও?
যে প্রেম ও ভালবাসাকে ভয় পায় সে মানুষ নয়, ইবলিশ।
মানুষের প্রকাশ্য শত্রু সে। মানুষ তার থেকে পরিত্রাণ চায়।

একজন কবিকে কারাগারে পাঠিয়ে তুমি নিজেই নিজেকে
সত্য ও সুন্দরের প্রতিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দিলে।
অসুন্দরকে কে ভালবাসে? কে ভালবাসে প্রেতরাত্রির অট্টহাসি?
একজন কবিকে বন্দী করে তুমি জগতকে জানিয়ে দিলে
তুমি প্রেম ও ভালবাসার দুশমন, সত্য ও সুন্দরের তুমি
আজন্ম প্রতিপক্ষ। মানুষের তুমি প্রকাশ্য শত্রু।

তাহলে ভালবাসাময় পৃথিবী থেকে তোমাকে তো নির্বাসন
নিতেই হবে। দুশমনকে কে কবে বুকে আগলে রাখে?
এবার বুঝেছি, এত সৈন্য, পাইক পিয়াদা, গোলাবারুদ থাকতেও
কেন তুমি কবিকে ভয় পাও? কেন সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকো?
কেন একটা উদভ্রান্ত তোমার হৃদয়?

কাজীপাড়া, মিরপুর। ৩০ জুন ২০১৩।















অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে হু হু করে ঢুকে পড়ছে মৃত্যু
লাল মৃত্যু, নীল মৃত্যু, হলুদ ও বেগুনি মৃত্যু
সাদা মৃত্যু, ধূসর মুত্যু, বোবা ও মুখর মৃত্যু।

আমাদের অর্থনীতির কন্ঠনালীতে প্রতিদিন
চাপ বাড়ছে অজস্র মৃত্যুর।
শেয়ার মার্কেটের এক ছোবলেই পয়ঁত্রিশ লক্ষ
পরিবার ছটফট করছে অসহ্য মৃত্যু যন্ত্রণায়।
মাড়োয়ারীদের দালালরা অবলীলায় ওদের হাতে
তুলে দিচ্ছে আমাদের ব্যবসা বাণিজ্য।
কোলকাতার প্রেসে ছাপা হচ্ছে আমাদের
সোনামনিদের জন্য পাঠ্যপুস্তক আর
আমাদের প্রেস কর্মচারীরা অন্ধকার লাইটপোস্টের
নিচে বসে বসে তারার আলোয় সাপলুডু খেলছে।

মৃত্যু এসে ছোবল হানছে আমাদের চেতনায়, মগজে
আমাদের হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য
গড়াগড়ি খাচ্ছে পায়ের নিচে। বেহুলার ঘরে
যেভাবে ঢুকে পড়েছিল সুতানটি সাপ
সেভাবেই আমাদের লেখকদের বুকের
খাঁচার ভেতর ঢুকে পড়েছে হীনমন্যতার পাপ।
তাদের কলমে এখন খেলা করে মনসার দেবী।
আর বিশ্বভারতীর কবুতর ঢাকার প্রাসাদগুলোর
খোপে খোপে বাকুম বাকুম খেলে।

মৃত্যু এসে হানা দিচ্ছে সংস্কৃতির জটিল জঙ্গমে।
ঢাকায় বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সময়
ভীনদেশী জাতীয় পাখি বর্ণাঢ্য স্টেডিয়ামে যখন
পেখম তুলে নাচছিল তখন জানি না আমাদের
জাতীয় পাখি দোয়েল দুবলার চরে বসে
গোলপাতা দিয়ে চোখের পানি মুছছিল কিনা?

তবে এটুকু জানি, ভীনদেশী শিল্পীর ভীড়ে
হারিয়ে গিয়েছিল আমাদের সব
নামীদামী তারকা শিল্পীরা।
আর আমাদের
সব মান সম্ভ্রম ধুলায় মিশিয়ে দিয়ে
দেশের মান্যবর মন্ত্রী মহোদয়
গুলিস্তানের ল্যাংড়া ফকিরের মত
মেঝেতে বসে
হাটুতে তাল ঠুকেছিলেন অনবরত।

এইসব দেথে দেখে শুধু মনে হয়,
আমার স্বদেশ এখন দুর্বৃত্তের হাতের পুতুল
রক্তে কেনা স্বদেশ আমার
লুট হচ্ছে প্রতিদিন প্রতি রাতে
লুট হচ্ছে বোনের ইজ্জত ও সম্ভ্রম,
লুট হচ্ছে সবুজ পতাকা।

হে যুবক, যদি স্বাধীনতা চাও
তোমার পেশী টান টান করে দাঁড়াও এবার।















মহীরুহ মরে না

প্রাচীন বৃক্ষেরা দৃশ্যত: একে একে মরে যায়,
কিন্তু আদৌ মরে কি? নবীন কিশলয় বৃক্ষ থেকে
সময়ের ব্যবধানে হয়ে গেলে সুবিশাল মহীরুহ
মৃত্তিকার অভ্যন্তরে দূর দূরান্ত পর্যন্ত তার
ছড়িয়ে পড়ে সুপুষ্ট শিকড়। কে না জানে,
সেখানেই বেঁচে থাকে তার প্রজ্ঞার সুরভী।

নবীন বৈশাখ পেলে, ভেজা মাটির স্পর্শ পেলে
কর্তিত কান্ডের চারদিক ঘিরে কিংবা
দূরাগত স্বপ্নের ভেতর লুকিয়ে থাকা বোধিবৃক্ষ
সবুজ স্বপ্নের ডানা মেলে মৃত্তিকার পলি স্তর উপড়ে
বেরিয়ে আসে কৌতুহলী কোমল কিশলয়।
এভাবেই জন্ম থেকে জন্মান্তরে কাল থেকে কালান্তরে
ভাবী প্রাচীন বৃক্ষেরা বার বার মহীরুহ হয়ে যায়।

তোমার অভিন্ন সুর ও স্বরÑ অভিন্ন স্বপ্নের বুনন
পুের অভিন্ন সৌরভ
ফলভারে নুয়ে পড়া কান্ডের অভিন্ন দৃঢ়তা
বাতাসের কানে কানে বলে যায়
না, না, বৃক্ষেরা মরে না, মহীরুহ মরে না।
মারা যায় ঘাসফুল, আগাছার উপদ্রব
ঐতিহ্যের শিকড় ছেঁড়া ছাকল-বাকল।

তাইতো পাললিক ইতিহাস ঘেটে দেখতে পাই
প্রাচীন বৃক্ষ থেকে জন্ম নেয় বৃক্ষের অযুত বীথি
যেমন আলাওল থেকে আল মাহমুদ
ড. শহীদুল¬াহ থেকে আকরাম খাঁ, গোলাম মোস্তফা
অভিন্ন চেতনাবাহী নজরুল, ফররুখ
এমনকি আশি ও নব্বইয়ের বোধিবৃক্ষের সারি
মূলধারার কবিকূল, শিল্পের অভিন্ন দোসর।
যেমন তুমি।




৮টি মন্তব্য:

  1. '
    প্রাচীন বৃক্ষেরা দৃশ্যত: একে একে মরে যায়,
    কিন্তু আদৌ মরে কি? নবীন কিশলয় বৃক্ষ থেকে
    সময়ের ব্যবধানে হয়ে গেলে সুবিশাল মহীরুহ
    মৃত্তিকার অভ্যন্তরে দূর দূরান্ত পর্যন্ত তার
    ছড়িয়ে পড়ে সুপুষ্ট শিকড়। কে না জানে,
    সেখানেই বেঁচে থাকে তার প্রজ্ঞার সুরভী।'

    মাশা আল্লাহ!

    উত্তরমুছুন
  2. মাশা আল্লাহ....
    থমকে দাঁড়ানো ক্লান্ত মসাফির আবারো সামনে চলার প্রেরণা পায় এখান থেকে...
    আল্লাহ উত্তম প্রতিদান দিন (আমীন)।

    উত্তরমুছুন
  3. অসাধারণ.. দোয়া করি, আল্লাহ তায়ালা কবিকে নেক হায়াত নসীব করুন।

    উত্তরমুছুন
  4. যুপোযোগী কবিতাগুলো লেখাহয়ে।

    উত্তরমুছুন